অচিন্ত মারিক- এর কবিতাগুচ্ছ ।। প্রিয় কবির কবিতা
পরাবাস্তব
এক মুহুর্তের জন্যও আমি
পৃথিবীর কোনো কাজে আসিনি স্তরে বিস্তরে
তাতে আমার কোনো দুঃখ নেই
হৃদয় বিছিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম মৃত্যুর অলিন্দে
ইতিহাস আর সংস্কৃতে ফেল মার্কশিট হাতে নিয়ে
জঞ্জাল মুহূর্ত সরিয়ে রেখে একটা লাফ দেব ভাবছি
কিন্তু অর্জিত উচ্চতা কম।
তাই সেদিন মৃত্যুদীপ সলতে জ্বালিয়ে যায়নি
এখন রোজকার যাত্রী রেলের
যখনই সেতু পেরোই, নদীর বালিময় দৃশ্য
চোখের প্রতিবেশী হয়ে থাকে
আমার দীর্ঘশ্বাস অক্ষর হয়ে ভেজা বালিতে
শুয়ে পড়ে গোঙায়
সেই পংক্তিময় বালির স্তুপ ক্রমে উচ্চ হয়
কংক্রিটের জ্যামিতিতে আটকে যাবে পলেস্তারা।
বেচারা বালির অক্ষর!
কেউ একটা পাত্রে ঢালছে জল, ঢালছে অক্ষর
বালির উপর দিয়ে নদীর নেমে আসা চিহ্নে
জল গভীর হয়, তবু বালি অবিরাম শুকনো।
পলাতক দিন রাত্রি
হারানো দিনগুলি রাতেও ফেরেনি
বহু ক্লেশে রাত জেগে দিনের পিঠে তৈরি শেষ
এবার হয়তো ফিরবে খুনসুটি নিয়ে
দিনের আলো অনেক অনেক দূরে রয়েছে
দূরে সরেছে সম্পর্কের মরদ ভাবনা
শুকনো শরীরে রঙের তীব্রতা স্পষ্ট হচ্ছে
মোদ্দা কথা এখানে কেউ কাউকে ভালোবাসে না।
না অন্ধকারে না আলোয়
পদ্য : দুই
নদীতটের মান ভাঙাতে
পাতার খসে পড়া ভাষা ঘর বাঁধে কবিতায়
সেও এক নূতন ভাষা পতনের
জিহ্বার তরঙ্গদৈর্ঘ্য তখন সুরের তালে যুগলবন্দী
এটা জানা মুশকিল নয় ভাষা বুঝলে
শ্লোকের অর্থ সহজে করা যায় কি না
এমন অনেক ভাষা আছে
প্রতিদিন যাচ্ছে হারিয়ে
কোনো উপায়ে পাতাগুলোর খসে পড়া
এবার বন্ধ করতেই হবে
পদ্য : এক
রোদের ঝাঁঝ তুমি অপছন্দ করতে পারো
তবু সুর্য কিরণ দেবেই
বৃষ্টির টাপুর টুপুর কি়ংবা অঝোর পড়া
তুমি বন্ধ করতে পারবে না - পড়বেই।
বৃষ্টি কী অবিরত? এখানে থামলেও
অন্য কোথাও সে কি ঝরে পড়ছে?
তোমার চোখের সামনে বৃষ্টি বিধৌত জলস্রোত
ধীরগতিতে নদীতে এসে মিশবে!
তাই এই কবিতা দেখে তুমি যদি বলো
রহস্যজনক হও - কবিতার মৃত্যু হোক।
হবে কি?
ঝরঝংকার
এক-একটা কণা ঝরে পড়ছে উপর থেকে
আকাশ যেন ক্রমে অস্পষ্ট মনে হচ্ছে
দিনের আলো মিশে যাচ্ছে রঙে বেরঙে
কণার অধঃপতনের সাথে
রাতের একাকীত্ব মশকরা করছে
আলিঙ্গনের অভাবে উদোম নৃত্য অনেক ভালো
কাকের ভিড়ভাট্টা শুরু হবে এবার শহরের রাস্তায়
রান্নাঘরের খোলা জানালায়
দেশি মদের দোকানের চাতালে
গতকালের তীক্ষ্ণ চোখের একটা চক্কর মনে পড়ে
নারীর সতীত্ব বিষয়ক উপপাদ্য
তিনি এবং আমি
তিনি মানে হীরের নেকলেস
আমার ভিক্ষার চাতালে এসে পড়েছিলেন তিনি
রামধনু ছিটকে পড়েছিল আমার কিনারে
একটা আকর্ণবিস্তৃত হাসির মতো
গোলাপি স্বপ্ন রূপালি হয়ে গেল দয়ায়
একটা আস্ত সমুদ্র সুখ হয়ে
চিতিয়ে পড়ল আমার চলার পথে
তবু তিনি এখন শত্-প্রতিশত্ সতী
সবাই জানে আমি এক অ্যালুমিনিয়ামের থালা।
মনের রঙচাবি
তুমি কি সেই হাভাতে পীড়িত প্রাণী
যে কেবল ব্যথায় কাতর সর্বদা
এক ফসলি শেষ ফলন তোমার পাঁজর ফাটিয়ে
ছাদের উল্টো পীঠে তাকায়
তোমার বিমূর্ত প্রতিলিপি
ফুলের মধ্য থেকে ফাঁদে পড়া নেশার
ডাঁটা চিবোতে থাকে
আত্মজা শরীর থেকে অদৃশ্য পৌরুষে
নিজের উত্তাপকে শীতল করে তোমার
অগ্নি নির্বাপক ইচ্ছার সন্তানেরা।
বোবা-শব্দে প্রতিবাদ করি উভয়ে
হারিয়ে যায় পুং ও স্ত্রী আবেগগুলো
কিভাবে
এবং বাঁশের বাঁশি সুরে সুরে কিভাবে জাদুকর হয়
কিভাবে দাবানল সবেগে ধাবিত হয়
কিভাবে যৌনতার অঙ্কুর যুবকের মতো সরীসৃপ হয়
কিভাবে সব সম্ভাবনা সরিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে প্রজন্ম
কিভাবে স্বর্গের সরোবরে হংসপুরুষ সাঁতরে চলে
কিভাবে নদীর বহমানতায় জড়ভরত ভাসে ভেলায়
কিভাবে ঝলসানো পড়াশোনা ডি লিট পায়
কিভাবে উদ্ভিদ তার স্ত্রীকে আলিঙ্গন করে
ঘুমে কাদা স্ত্রীলোক কিভাবে শুনবে এসব!
অলঙ্কার আর লজ্জাবস্ত্র স্তনের উপর গড়াগড়ি যাক
বৃষ্টি পড়ে মহাবিশ্বের পাগল কেন্দ্রবিন্দুতে
স্নান জলের অভাবে মৃত্যু অরন্ধন পালন করে কিভাবে
চিত্র ৫
নীল জলের সাদা লিলি সেই কলেজ মেয়ে
সঙ্গীতের সম্রাজ্ঞী তাই বীতরাগের প্রেয়সী
তার স্বপ্নময় মুখচ্ছবিগুলি আবলুস পিয়ানোয়
ঝঙ্কার তোলে নীল থেকে সাদা স্বরলিপিতে
যে কৃষক ফেলে রেখে গেছে তার লাঙ্গল
অথবা মাছ ধরা জেলের পড়ে থাকা ভেজা জাল
যন্ত্র আর যন্ত্রীর প্রেমের মতো নির্মাণ বিশুদ্ধ হলেও
তোমার প্রতিকৃতি তোমারই খুঁত ধরে
জলের মধ্যে তোমার মানপুরুষ শায়িত
যাবতীয় উৎসাহ এখন যন্ত্রনায় সংকুচিত কপোত
ফসল তোলা গানের সুরে চমরী গাই-এর গোঙানি
শুনি, ওল গাছগুলো গাঁদা ফুলের চুম্বনে লজ্জিত
ছেনি, পাথর এবং ঘুম
গানের মধ্যে গান আমার
ঘুমের মধ্যে ঘুম
একখণ্ড এলোমেলো পাথরে জ্যোৎস্না অস্থির
ছেনির ধারে কত শত পাথর
মুখের মধ্যে মুখ
নারী দেহের বিবর্তনে পাথর কুঁদে স্থবির
কোলের খাঁজে শিশু আটকে
স্তনের মধ্যে স্তন
অসীম দূরত্বে দুগ্ধপান ঘুম ঘিরেছে চোখ
সময়ের বোঝা রাতের হুমকি
আত্মার মাঝে আত্মা
ছেনির মারে রক্ত ঝরে ঘণ্টা বাজায় লোক
সুগন্ধী বৃষ্টি
যে রাস্তায় যাই না কেন সুগন্ধটা ফিরে ফিরে আসে
আমার নাকের চারপাশে অবিরাম ঘোরে
যেন সুগন্ধী ফুল কেউ বেঁধে দিয়েছে
আচমকা চুমু খাওয়ার গালে
কেমন করে সম্ভব হলো বলো!
আমি নিশ্চিত, যেন চন্দন ঘষে দিয়েছ অদৃশ্য হাতে
অথবা দখিনা বাতাস চাঁপার সুগন্ধী ছড়িয়েছে,
সেই বাতাস চন্দ্রভাগা হয়ে বয়ে যায়
যখন রাতের ঝরঝর বৃষ্টি মেতে ওঠে ঝমঝমে।
ফুলের গুচ্ছচেহারা উঁকি দেয় আর
আকাশের নীল আড়াল লুকিয়ে থাকে চোখে;
একটি লাল-হলুদ শামিয়ানা উৎসবে
আতিথ্যে জোটে বৃষ্টির ধ্বনি টুপ টুপ মিহিশব্দে।
উলঙ্গ ফুলের ঝোপের ভিতর উদাসীন বৃষ্টি
আমার স্মৃতিকে ধাক্কা দিয়ে অতিক্রম করে
ভাসমান ভেলার বাহারি রৌপ্য ডিঙা।
সূর্যঘুড়ি গাছের শাখায় লতাজুড়ে ফুল ফোটে,
বসন্তের পেছনে পেছনে আসে শুষ্ক সমীরণ আর
জুঁই ফুলের বৃষ্টি-নেশা গন্ধ।
ভরা বসন্তে অসুখে পড়েছে মিষ্টি মিষ্টি মেয়েরা
তাদের নরম বয়সের নীরব লজ্জা
পাপড়ির আবরণ খুলে খুলে প্রদর্শিত হবে –
আমার ছদ্মবেশ স্বপ্নাত্মা দু-চোখ ভরে দেখবে।
এখনও এমন স্মৃতি বৃষ্টির সুবাস নিয়ে হাজির হয়,
পা টেনে টেনে চলে আমার হাস্যকর জীবনে
বৃষ্টি থেকে অনাবৃষ্টি পর্যন্ত অদ্ভুতভাবে,
সুগন্ধী ঘ্রাণে হৃদয়ের প্রত্যাবর্তন অনিবার্য হয়।
।। আনন্দ ।।
ReplyDelete